১০টি জরুরি পুষ্টি বার্তা যা জেনে রাখা অত্যাবশ্যক



শরীর সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যাবশ্যক। এর সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ করতে অবশ্যই পুষ্টিবিজ্ঞান সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই এরকম ১০টি বার্তা রয়েছে যা মেনে চললে বিভিন্ন ধরনের রোগকে প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং সর্বোপরি শরীরকে সুস্থ সবল রাখা সম্ভব।

১. সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং খাবারে বৈচিত্র্যতা বজায় রাখাঃ শরীর সুস্থ রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে সুষম খাদ্যাভ্যাস সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা জানি খাদ্যে ৬ ধরনের উপাদান পাওয়া যায় যেমন শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানি। এসব খাদ্য উপাদান দৈনিক একটি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। একই খাবার প্রতিদিন খেলে খাবারের প্রতি আগ্রহ এবং রুচি কমে যায়। তাই অবশ্যই সুষম খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈচিত্রতা নিয়ে আসতে হবে।

২.পরিমিত পরিমাণে তেল চর্বি খাওয়াঃ দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন জটিল রোগের জন্য সাধারণত তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার অনেকটাই দায়ী। সুতরাং তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একজন ব্যক্তি তার জন্য একদিনের রান্নায় সর্বোচ্চ ৩০ গ্রাম তেল ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া  অতিরিক্ত ভাজাপোড়া এবং একই তেল  বারবার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৩. সীমিত পরিমাণে লবণ গ্রহণ এবং অবশ্যই আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়াঃ বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন কিডনি রোগ,  হৃদরোগ ইত্যাদির  ঝুঁকি বৃদ্ধিতে  অতিরিক্ত লবণ একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সুতরাং লবণ গ্রহণের প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগী হতে হবে। একজন ব্যক্তি দৈনিক সর্বোচ্চ ১ চা-চামচ লবণ খেতে পারেন। মনে করুন চারজন সদস্যের একটি পরিবারের জন্য দৈনিক রান্নায় বা খাবারে   সর্বোচ্চ ৪ চা-চামচ লবণ ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়া কাঁচা লবণ বিশেষত পাতে লবণ খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করতে হবে।


৪. চিনি, মিষ্টি বা চিনিজাতীয় খাবারের পরিমাণ কমানোঃ বেশি মিষ্টি খাস না ডায়াবেটিস হবে এরকম একটি ধারণা অনেকের মধ্যে থেকে থাকে যদিও এই তথ্যের সঠিকতা নেই। তবে মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া অনেকটাই ক্ষতিকর। চিনিকে হোয়াইট পয়জন বা সাদা বিষ বলে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণের ফলে আমাদের মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না। ফলেথেকে প্রাপ্ত ফ্রুক্টোজ মস্তিষ্কে ভুল বার্তা প্রেরণ করে  যার ফলে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায় এবং স্থূলতার ঝুঁকিও বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে একজন ব্যক্তি দৈনিক তার খাদ্যশক্তির ৫ থেকে ১০ শতাংশ চিনি বা চিনিজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে পারেন। তাই যেহেতু আমরা জানি স্থূলতা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ যেমন হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ক্যান্সার,  ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের জন্য দায়ী তাই স্থূলতা কমানোর জন্য চিনি বা চিনি জাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত। তাছাড়া চিনিজাতীয় খাবারের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন আম, কাঁঠাল, তরমুজ ইত্যাদি খেতে পারেন।

৫. পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করাঃ খাদ্য ছাড়া কিছু সময় বা মুহুর্ত  বেঁচে থাকা সম্ভব হলেও পানি ছাড়া বেঁচে থাকা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে পানির অপর নাম জীবন। তবে খেয়াল রাখতে হবে খাবার পানি যেন সবসময় বিশুদ্ধ থাকে। দেহের বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পন্ন করতে পানি একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তিভেদে একজন সুস্থ ব্যক্তির দৈনিক দেড় লিটার থেকে সাড়ে তিন লিটার পানি পান করা উচিত। তবে শারীরিক গঠন, শারীরিক পরিশ্রম ও অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর ভিত্তি করে পানি পান করার পরিমাণে কমবেশি হতে পারে।

৬. নিরাপদ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করাঃ নিরাপদ খাদ্য ও পানি শরীর সুস্থ রাখার পূর্ব শর্ত। কেননা খাদ্য বা পানির মাধ্যমেই আমাদের দেহে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে সঠিক দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বদা তাজা ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাসি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।


৭. নিয়ন্ত্রিত খাদ্যভ্যাস এবং শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে কাঙ্খিত ওজন ঠিক রাখাঃ আমরা জানি সুস্থ শরীরে সুস্থ মনের বসবাস। স্থূলতা বাড়লে মনের অবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। উচ্চতার তুলনায় আপনার ওজন ঠিক আছে কিনা তা বিএমআই ক্যালকুলেটর দিয়ে সহজেই জেনে নিতে পারবেন।  সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখলে শরীর ও মন উভয়ই ভালো থাকে। দৈনিক 30 থেকে 45 মিনিট শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামের মাধ্যমে এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে শরীরকে সুস্থ সবল রাখা সম্ভব।  তাই এ বিষয়ে আমাদের সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

৮. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক উপায়ে রান্নার কৌশল ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলাঃ শরীর সুস্থ রাখতে, মন ভালো রাখতে এবং স্থূলতা প্রতিরোধ করতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক উপায়ে রান্না এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জেনে অবাক হবেন যে আমাদের অধিকাংশই পুষ্টি ভুল রান্না পদ্ধতির মাধ্যমেউ নষ্ট হয়ে যায়। এখনো অনেক পরিবার রয়েছে যারা শাক কাটার পরেও ধুয়ে থাকেন, অধিক তাপে রান্না করেন, রান্নায় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করেন না ইত্যাদি। যা আমাদের পুষ্টি চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ করতে পারেনা। সবজি কাটার সময় তুলনামূলক ভাবে একটু বড় করে  কাটতে হবে। শাক রান্নার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল ব্যবহার করতে হবে। এতে করে শাকের মধ্যে পাওয়া পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরে কাজে লাগবে। এছাড়া জীবনযাপনে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। দৈনিক পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ৭ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন। এছাড়া স্বাস্থ্যকর উপায়ে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ২০ সেকেন্ড ধরে ধুয়ে নিতে হবে। এছাড়া  সর্বদা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে।



৯.গর্ভকালীন ও দুগ্ধদানকালীন সময়ে অধিক খাদ্যগ্রহণের প্রতি জোর দেওয়াঃ গর্ভকালীন সময়ে একজন গর্ভবতী মায়ের খাদ্য গ্রহণের প্রতি আমাদের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণের প্রতি জোর দিতে হবে। দৈনিক ভাত এবং ডাল ছাড়াও ৫ ধরনের খাবার খেতে হবে। মাছ অথবা মাংস, ডিম,  দুধ অথবা দুধের তৈরি খাবার, সবুজ রংয়ের শাক এবং হলুদ বা কমলা রংয়ের ফল বা সবজি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। দুগ্ধদানকারী মায়ের খাদ্য তালিকায় উল্লেখ্য ৫ ধরনের খাবার রাখতে হবে। সাধারণ কথায় একজন গর্ভবতী মাকে প্রতিবার খাবারে একমুঠো বেশি করে খেতে হবে এবং দুগ্ধদানকারী মাকে প্রতিবারে দুই মুঠো বেশি করে খাবার খেতে হবে।  দৈনিক খাদ্য তালিকায় টক জাতীয় ফল রাখতে হবে এবং সকাল এবং বিকালে নাস্তা করতে হবে। মোটকথা কিছুক্ষণ পরপর অল্প অল্প করে হলেও খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

১০. শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করাঃ জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে শালদুধ খাওয়াতে হবে। শালদুধ ব্যতীত মধু বা অন্য কিছু দেওয়া যাবে না যা শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এরপর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে বাইরের কোন খাবার এমনকি এক ফোটা পানিও দেওয়া যাবে না। ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার খাওয়াতে হবে। বাইরের খাবার দেওয়া থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা বাইরের অধিক চিনিযুক্ত, তেল ও লবণযুক্ত খাবার শিশির স্থূলতা বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সর্বোপরি শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

-পুষ্টিবিদ মোঃ আকতারুল ইসলাম
প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা (পুষ্টি),
এনডিপি
বিএসসি (অনার্স), খাদ্য প্রযুক্তি ও পুষ্টিবিজ্ঞান,
এমএসসি,খাদ্যের নিরাপদতা ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি,
নোবিপ্রবি


No comments

Theme images by rajareddychadive. Powered by Blogger.