অধিক আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা কি ক্ষতিকর?
আমিষ আমাদের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক একটি উপাদান। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম আমিষ প্রয়োজন।তবে এই আমিষ গ্রহণ নিয়ে অনেকের মাঝে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকের ধারণা যে অধিক আমিষ গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেকে ভাবেন অধিক আমিষ গ্রহণ কিডনি রোগ, অস্টিওপরোসিস বা হাড় ক্ষয়, লিভারের রোগ, হৃদরোগ এসবের জন্য দায়ী। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি তাদের একটি ভুল ধারণা।
চলুন এবার আসল কথায় আসি। কিডনি আমাদের অতি মূল্যবান অঙ্গ বা অর্গান। এর প্রধান কাজ দেহ থেকে ক্ষতিকর উপাদান বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপাদান বের করে দেওয়া। এখন কোন ব্যক্তি যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে তার কিডনি সেই চাপ নিতে পারে না। ফলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অতি মূল্যবান উপাদান যেমন আমিষ প্রসাবের সাথে বের হয়ে যায়। এজন্য কিডনি রোগীকে চিকিৎসকগণ পরিমিত পরিমাণে আমিষ খেতে বলেন। সেক্ষেত্রে অধিক আমিষ তার জন্য ক্ষতিকর।কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় তার জন্য কোন নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না।স্বাতভাবিক অবস্থায় যে পরিমাণ আমিষ গ্রহণ করা হোক না কেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপাদান বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেহে বন্টন হয় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
উদাহরণসরূপ দৌড়ানো একটি ভাল এবং স্বাস্থ্যকর ব্যায়াম যখন ঐ ব্যক্তিটি স্বাভাবিক পায়ের অধিকারী থাকে। কিন্তু যদি পা ভাঙ্গা থাকে তবে চিকিৎসক তাকে বিশ্রাম নিতে বলেন। তারমানে দৌড়ানোর সাথে পা ভাঙ্গার কোন সম্পর্ক নাই বা শুধু দৌড়ে কারো পা ভাঙ্গে না এবং চিকিৎসকগণও কাউকে দৌড়াতে নিষেধ করেন না।কিন্তু পা ভাঙ্গা থাকলে তাকে দৌড়ানোর পরিবর্তে বিশ্রাম নিতে বলেন।
একই উদাহরণ লিভার বা যকৃত রোগীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দেহের সমস্ত খাদ্য পরিপাকে লিভার বা যকৃতের অবদান সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।লিভার সিরোসিস হলে চিকিৎসকগণ বেশি আমিষ গ্রহণে নিষেধ করেন। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও নিষেধ করেন না। কারণ এই রোগ হয়ে যাওয়ার ফলে লিভার ঠিকমত কাজ করতে পারে না। কিন্তু সিরোসিস হওয়ার জন্য কখনই অতিরিক্ত আমিষ দায়ী নয়।
এবার আসি অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয়ের প্রসঙ্গে। অনেকে মনে করেন হাড় ক্ষয়ের জন্য অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণ দায়ী।কিন্তু ব্যাপারটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন বোন মিনারেল বা হাড়ের খনিজ লবণগুলো আমিষজাতীয় খাবারেই বেশি থাকে। হাড় কোলাজেন জাতীয় উপাদান দিয়ে গঠিত। সেক্ষেত্রে কোলাজেনও একটি আমিষ এবং হাড়ের গুণাগুণ ঠিক রাখতে তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ আমিষ আরো গুরুত্বপূর্ণ।সুতরাং অধিক আমিষ হাড় ক্ষয় নয় বরং হাড়ে ক্যালসিয়াম বা কোলাজেন উপাদান বৃদ্ধি করতে সর্বপরি হাড়ের গুণাগুণ ঠিক রাখতে অধিক কার্যকরী।
হৃৎপিন্ড আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অরগান বা অঙ্গ। শরীরে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে এটি ২৪ ঘন্টা কাজ করে যায়। অনেকের ভুল ধারণা অধিক আমিষ হৃদরোগের কারণ। কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়।মূলত হৃৎপিন্ডের রোগের জন্য চর্বির তআধিক্য দায়ী। সেক্ষেত্রে প্রাণিজ আমিষ পরিমাণমত খেতে হবে কারণ প্রাণিজ আমিষের সাথে চর্বিও থাকে। আমরা জানি দুধ ও ডিম আদর্শ আমিষ জাতীয় খাদ্য। এতে আমিষের মূল উপাদান অ্যামাইনো এসিড প্রকৃতপক্ষে অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। পক্ষান্তরে উদ্ভিদজাতীয় খাবারে অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড খুবই অল্প পরিমাণে থাকে।সেক্ষেত্রে আমাদের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত পরিমাণ আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা জরুরি। তাই হৃদরোগের জন্য আমিষ নয় অতিরিক্ত ফ্যাট বা চর্বি গ্রহণ বেশি দায়ী।
সর্বপরি বিভিন্ন উপাদানের তারতম্যের কারণে বিভিন্ন অসুখের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্যনীয়। অনেক সময় দেখা যায় একটি রোগ সৃষ্টির জন্য অনেক বিষয় জড়িত থাকে। তার মানে ঐসব রোগ নির্নয়ে সবগুলো বিষয় নিয়ে গবেষনা করতে হয়। এক ধরনের উপাদান অন্য ধরনের উপাদান ছাড়া অনেকসময় কাজ করে না।
সুতরাং অন্যান্য উপাদানের মত পর্যাপ্ত পরিমাণে আমিষ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।আমিষ আমাদের দেহের ক্ষয় পূরণ করে, ত্বক, চুল, নখ ইত্যাদির যত্ন নেয়। সুতরাং এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আমরা যে আমিষ গ্রহণ করি তা অ্যামাইনো এসিডে রূপান্তরিত হয়। আর আমাদের শরীরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন উপাদান শোষিত হয় এবং অতিরিক্ত উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত আমিষ গ্রহণে যতটুকু শরীরের জন্য প্রয়োজন ততটুকু নিয়ে বাকিটুকু শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এছাড়া আমিষ শারীরিক প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন অবস্থায় পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সাধারণত মানুষদের মধ্যে আমিষের আধিক্যের তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ বেশি থাকে। সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় আমিষ কোন ক্ষতি করে না। তবে প্রতিনিয়ত বেশি আমিষ বিশেষত চর্বি সমৃদ্ধ প্রাণিজ আমিষ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু ব্যক্তিভেদে আমাদের প্রত্যেকের আলাদা পরিমাণ খাদ্যশক্তি প্রয়োজন তাই কোন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের থেকে আপনার জন্য পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ জেনে নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে একটি কার্যকরী খাদ্য তালিকা তৈরি করে নিতে পারেন।
-পুষ্টিবিদ মোঃ আকতারুল ইসলাম
-পুষ্টিবিদ মোঃ আকতারুল ইসলাম
No comments